বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩৬ হাজার। ৬ জুলাই ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এটিই দেশের একমাত্র সয়ংসম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় ও ডিজিটাল ক্যাম্পাস। রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রেলওয়ে স্টেশন ও ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের পাশে এই প্রতিষ্ঠানটি অবস্থিত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট এবং নিয়ম-নীতি। আজ আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করবো। পাশাপাশি জানবো এখানে ভর্তি পদ্ধতি ও আনুষঙ্গিক সবকিছুই। বিস্তারিত জানতে মনোযোগ সহকারে পড়তে থাকুন।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয় মূলত ভাষা আন্দোলনের কিছুদিন আগে থেকে। ৬৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয় এবং সর্বপ্রথম ১৯৫২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষার্থীরা রাজশাহী কলেজ ক্যাম্পাসে সমবেত হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ পাশ করার দাবি জানায়।
পরবর্তীতে এই দাবি ক্রমেই তীব্র হতে থাকে। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ঢাকায় একটি ডেলিগেশন পাঠানো হয়, সদস্যদের মধ্যে মরহুম আবুল কালাম চৌধুরী ও আব্দুর রহমানের নাম উল্লেখযোগ্য। ধারাবাহিকভাবে একের পর এক আন্দোলনের চাপে স্থানীয় আইন পরিষদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে।
১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন প্রাদেশিক আইনসভায় অনুমোদিত হয়। নতুন উপাচার্য প্রফেসর ইতরাত হোসেন জুবেরী ও মাদারবখশ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা কাঠামো প্রণয়ন করে। পরে এই দুইজনকে যুগ্ম সম্পাদক করে ৬৪ সদস্য বিশিষ্ট বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়। সেই বছর ৬ জুলাই তারিখে ১৬১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে।
অনুষদ ও ইনস্টিটিউট
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১ টি অনুষদে মোট ৫৯ টি বিভাগ রয়েছে। তাছাড়া অধিভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১১ টি সরকারী ও ২৪ টি বেসরকারী সহ মোট ৪১ টি প্রতিষ্ঠান আছে। এখানকার অনুষদগুলো হলোঃ
১. কলা অনুষদ
২. বিজ্ঞান অনুষদ
৩. প্রকৌশল অনুষদ
৪. কৃষি অনুষদ
৫. বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ
৬. সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ
৭. আইন অনুষদ
৮. জীব ও ভূ-বিজ্ঞান অনুষদ
৯. চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুষদ
১০. চারুকলা অনুষদ
১১. ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্স অনুষদ
তাছাড়া ৫ টি উচ্চতর গবেষণা ইনস্টিটিউট রয়েছে, যেগুলো হলোঃ
১. ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ
২. ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্স
৩. ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট
৪. পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট
৫. শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
ভর্তি প্রক্রিয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তি পরীক্ষার ইউনিট কমিয়ে তিনটি ইউনিট নির্ধারণ করে। যার মধ্যে কলা, আইন, সামাজিক বিজ্ঞান, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটগুলো ’এ’ ইউনিট এর অন্তর্ভুক্ত। বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ ও ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট ’বি’ ইউনিট এর অন্তর্ভুক্ত এবং বিজ্ঞান, জীব ও ভূ-বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদ ‘সি’ ইউনিট এর অন্তর্ভূক্ত।
ভর্তি যোগ্যতা
যে সমস্ত শিক্ষার্থীদের এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত জিপিএ মান অনুযায়ী বা তার উপরে থাকবে কেবলমাত্র তারাই এখানে ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারবে। এটি ইউনিটভেদে আলাদা হয়ে থাকে। যেমন-
’এ’ ইউনিট (মানবিক বিভাগ): মানবিক শাখা থেকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র ‘এ’ ইউনিটে আবেদন করতে পারবে। যোগ্যতা হিসাবে এসএসসি অথবা সমমান এবং এইচএসসি অথবা সমমান উভয় পরীক্ষায় চতুর্থ বিষয় সহ মোট জিপিএ ন্যূনতম ৭.০০ থাকতে হবে। আলাদাভাবে কোন পরীক্ষায় জিপিএ ৩.০০ এর নীচে থাকতে পারবে না।
‘বি’ ইউনিট (বানিজ্য বিভাগ): বানিজ্য শাখা থেকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র ‘বি’ ইউনিটে ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারবে। যোগ্যতা হিসাবে এসএসসি অথবা সমমান এবং এইচএসসি অথবা সমমান উভয় পরীক্ষায় চতুর্থ বিষয় সহ মোট জিপিএ ন্যূনতম ৭.৫০ থাকতে হবে। আলাদাভাবে কোন পরীক্ষায় জিপিএ ৩.৫০ এর নীচে থাকতে পারবে না।
’সি’ ইউনিট (বিজ্ঞান বিভাগ): বিজ্ঞান শাখা থেকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র ‘সি’ ইউনিটে ভর্তির আবেদন করতে পারবে। যোগ্যতা হিসাবে এসএসসি অথবা সমমান এবং এইচএসসি অথবা সমমান উভয় পরীক্ষায় চতুর্থ বিষয় সহ মোট জিপিএ ন্যূনতম ৮.০০ থাকতে হবে। আলাদাভাবে কোন পরীক্ষায় জিপিএ ৩.৫০ এর নীচে থাকতে পারবে না।
এইচএসসি সমমান নির্ধারণ কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন ডিপ্লোমা-ইন-কমার্স, বাংলাদেশ কারিগরী শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এইচএসসি (ভকেশনাল), লেভেল ‘এ’ এবং অন্যান্য সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারবে। তবে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা এখানে ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারবে না।
’ও’ লেভেল পরীক্ষায় ৫টি বিষয়ে এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষায় অন্তত ৪ টি বিষয়ে উত্তীর্ণ হতে হবে। উভয় লেভেলে ৭ টি বিষয়ের মধ্যে কমপক্ষে ৪ টি বিষয়ে ‘বি’ গ্রেড এবং ৩ টি বিষয়ে ‘সি’ গ্রেড থাকতে হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন
প্রতিটি ইউনিটে ৪৫০০০ করে মোট ১ লাখ ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীকে চুড়ান্তভাবে আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা অনলাইনে রকেট পেমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে ৫৫ টাকা পরিশোধ করে ভর্তির আবেদন করতে পারবে। চুড়ান্ত পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদেরকে ১১০০ টাকা ফি পরিশোধ করে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে।
তবে বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তি পরীক্ষায় কিছু পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি ২ টি ধাপে সম্পন্ন হয়।
প্রথম ধাপে ৫৫ টাকা ফি দিয়ে আবেদন করতে হয়। আবেদন শেষে কোটা ও জিপিএ এর ভিত্তিতে প্রতি ইউনিটের জন্য ৩২ হাজার শিক্ষার্থীকে পরীক্ষার জন্য কর্তৃপক্ষ নির্বাচিত করবে। প্রাতমিক ধাপ অতিক্রম করার পরে পরীক্ষার্থীরা দ্বিতীয় ধাপে আসতে পারবে।
দ্বিতীয় ধাপে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম ধাপে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা ১১০০ টাকা ফি জমা দিয়ে চুড়ান্ত আবেদন সম্পন্ন করবে এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। পরীক্ষার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে মেধা তালিকা অনুযায়ী ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর যাবতীয় সকল তথ্য!
ভর্তি পরীক্ষা ও মানবন্টন
মোট ১০০ নম্বরের ভর্তি পরীক্ষা এমসিকিউ পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়। মোট প্রশ্ন থাকে ৮০ টি, প্রতিটি প্রশ্নের মান ১.২৫। পাশ নম্বর ৪০। বিস্তারিত মান বন্টন নীচে উল্লেখ করা হলো।
’এ’ ইউনিটের জন্য বাংলা অংশে ৩০, ইংরেজি অংশে ৩০ এবং সাধারণ জ্ঞান অংশে ৪০ নম্বরের প্রশ্ন থাকে। তাছাড়া বিভাগ পরিবর্তনে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদেরও একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। মোট আসনের ৬০% মানবিকের জন্য নির্ধারিত থাকে, বাকি আসনগুলো অন্য বিভাগের জন্য।
‘বি’ ইউনিটের পরীক্ষার্থীদের ইংরেজিতে ২৫, আইসিটিতে ১৫, হিসাব বিজ্ঞানে ২৫, ব্যবসায় সংগঠন ও ব্যবস্থাপনায় ২৫ একং বাংলায় ১০ নম্বরের প্রশ্ন থাকে। অবানিজ্য শিক্ষার্থীদের জন্য ইংরেজিতে ৩০, বাংলায় ২০, সাধারণ জ্ঞানে ২৫ এবং আইসিটিতে ২৫ নম্বরের প্রশ্ন থাকে। অ্যাসাইনমেন্ট লেখার সঠিক নিয়মাবলী জেনে নিন!
’সি’ ইউনিটের শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন ক ও খ শাখায় বিভক্ত থাকে। ক শাখা বাধ্যতামূলক, এখানে পদার্থ বিজ্ঞানে ২৫, রসায়নে ২৫ এবং আইসিটি থেকে ৫ টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। খ শাখায় ২৫ নম্বরের যে কোন একটি বিষয়ের উত্তর দিতে হয়। যার মধ্যে গণিত, জীববিজ্ঞান এবং সম্মিলিতভাবে গণিত ও জীববিজ্ঞান থাকে।
আসন সংখ্যা
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৪১৯১ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পায়। যার মধ্যে ‘এ’ ইউনিটের আসন সংখ্যা ২০১৯ টি। ‘বি’ ইউনিটে ৫৬০ টি এবং ‘সি’ ইউনিটে মোট আসন সংখ্যা ১৬১২ টি।
ক্যাম্পাস রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রায় ৭৫৩ বা ৩০৪ হেক্টর এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। সাধারণ শিক্ষার্থী ও গবেষকদের প্রয়োজনে বা সহায়ক হিসাবে এখানে রয়েছে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, বিভাগীয় সেমিনার লইব্রেরী। তাছাড়া বিভাগীয় কম্পিউটার ল্যাব, ইনস্টিটিউট ও অনুষদ লাইব্রেরী, কম্পিউটার সেন্টার এবং বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর।
খেলাধুলার জন্য স্টেডিয়াম, জিমনেশিয়াম, সুইমিং পুল, সাংস্কৃতি চর্চার জন্য শিক্ষক-ছাত্র সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সহ রয়েছে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। এছাড়া বিভিন্ন ভাস্কর্য যেমন শহীদ মিনার কমপ্লেক্স, সাবাশ বাংলাদেশ, বিদ্যার্ঘ, স্ফুলিঙ্গ, সুবর্ণ জয়ন্তি টাওয়ার ইত্যাদি এই ক্যাম্পাসকে অলংকৃত করেছে। খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এর সকল তথ্য!
আবাসিক হলসমূহ
শিক্ষার্থীদের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৭ টি হল ও একটি আন্তর্যাতিক মানের ডরমেটরির মাধ্যমে আবাসিক সুবিধা প্রদান করে থাকে। হলগুলোর মধ্যে ১১ টি ছেলেদের জন্য এবং ৬ টি মেয়েদের জন্য নির্ধারিত।
উপসংহার
প্রাচ্যের ক্যামব্রিজ খ্যাত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের উচ্চ শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিভিন্ন বিষয়ে এখানকার শিক্ষার্থীরা সম্মুখ নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় রেখেছে অনন্য ভূমিকা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা দেশের প্রথম বুদ্দিজীবী হিসাবে শহীদ হছেছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এই প্রতিষ্ঠানটি আন্দোলন সংগ্রামে অতুলনীয় ভূমিকা রেখেছে।