অপারেশন জ্যাকপট কি? পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ সহ হামলার দিক নির্দেশনা এবং ফলাফল!
অপারেশন জ্যাকপট কি

অপারেশন জ্যাকপট কি? পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ সহ হামলার দিক নির্দেশনা এবং ফলাফল!

অপারেশন জ্যাকপট কি : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে নৌ অপারেশন গুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ অপারেশন হল অপারেশন জ্যাকপট। এটি ছিল নৌ কমান্ডো বাহিনীর প্রথম অভিযান। অপারেশন জ্যাকপট একটি বিপদজনক ও আত্মঘাতী অপারেশন, যা কেবল পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয় নি। এই অভিযানটি সাড়া ফেলে দিয়েছিল সারা বিশ্বে। 

আজকে আমরা অপারেশন জ্যাকপট কি এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। 

অপারেশন জ্যাকপট কি

অপারেশন জ্যাকপটের পরিকল্পনা এবং প্রশিক্ষণ 

১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের ১৫ তারিখ রাতের বেলা অপারেশন জ্যাকপট পরিচালনার সময় নির্ধারিত হয়। তবে প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল একই  বছরের মে মাসে। 

প্রথমত নৌ কমান্ডো বাহিনীর প্রশিক্ষণ এর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন ভারতীয় লেভেল অফিসার কমান্ডার এম এন সামানত। এছাড়াও আরো ২০ জন ভারতীয় প্রশিক্ষক ছিল। ট্রেনিং কে প্রথমে দুটি অংশে ভাগ করা হয়। 

তৎকালীন সময়ে এক নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর রফিকুল ইসলাম। তার তত্ত্বাবধানে  সুপরিকল্পিত ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয় অভিযানটি।

এই অপারেশনের প্রধান লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর সরঞ্জাম ও রসদ পরিবহণ ব্যাহত করা। এই পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ২৩ শে মে ভারতীয় নৌবাহিনীর সাহায্যে ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশী স্মৃতিসৌধের নিকট একটি গোপন ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হয়।

এই ট্রেনিং ক্যাম্পটির নাম দেওয়া হয়েছে সি- টু -পি। এরপর পরবর্তী মাসের প্রথমদিকে অন্যান্য সেক্টর থেকে বাছাই করা স্বাস্থ্যবান  ও ভালো সাঁতার জানেন এমন ৩০০ জনের একটি দলকে সি-টু- পি ক্যাম্পে এনে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে। 

প্রশিক্ষণার্থীরা যাতে  দীর্ঘক্ষন স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে পারে সে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। নানা ধরনের মাইন, বৌমা ও বিস্ফোরণ যাতে বহন করে নিয়ে যেতে পারে সে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। 

অভিযান পরিচালনা করার আগে পূর্ব পরিকল্পনা করা হয়েছিল যে একই দিনে একই সময়ে মংলা ও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর এবং নারায়ণগঞ্জ ও চাঁদপুর নদী বন্দরে হামলা চালানো হবে। পরবর্তীতে অভিযানটির নামকরণ করা হয়েছিল অপারেশন জ্যাকপট। 

রেডিও সংকেতে হামলার দিক নির্দেশনা 

নৌ-কমান্ডো রফিকুল ইসলাম ছিলেন মংলায় অপারেশন জ্যাকপট দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য। তিনি আগেই তার গেরিলা যোদ্ধাদের জানিয়ে দিয়েছেন যে এটি একটি আত্মঘাতী অপারেশন হতে যাচ্ছে। 

অপেরেশন শুরুর আগেই সব যোদ্ধাদের থেকে সম্মতিসূচক স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছিল। চারটি বন্দরে হামলা পরিচালনা করার জন্য চারটি ছোট ছোট দলে বিভক্ত করা হয়েছে। 

চারটি দলের কমান্ডোদের আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল যে, রেডিওতে আকাশবাণী কলকাতা স্টেশন থেকে পূর্বাঞ্চলীয় শ্রোতাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানে বাংলা দুটি গানকে সংকেত হিসেবে ব্যবহার করা হবে। 

এর মধ্যে প্রথম গানটি হচ্ছে “আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান” এর মানে হলো আগামী ২৪  ঘন্টার মধ্যে আক্রমণ পরিচালনা করতেই হবে। এরপর দ্বিতীয় গানটি ছিল “আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ি” এই সংকেত টির মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে আক্রমণের জন্য ঘাঁটি ত্যাগ কর।

চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে অভিযান

অপারেশন জ্যাকপট এর চট্টগ্রাম বন্দরের অভিযানটি পরিচালনা করেন সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম। যোদ্ধারা চট্টগ্রাম বন্দরে এসে প্রথমে কর্ণফুলী নদীতে জাহাজ চলাচল সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য জেনে নিল  এবং পরবর্তীতে আবহাওয়ার  অবস্থা, বাতাসের বেগ, জোয়ার ভাটার সময় স্রোতের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে  ভালোভাবে তথ্য সংগ্রহ করে বুঝে নিয়েছিল।

৬০ সদস্যের একটি দলকে চট্টগ্রাম বন্দরে অপারেশন চালানোর জন্য বাছাই করা হয়। পরবর্তীতে সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম জানান যে প্রতিটি নৌ কমান্ডো একটি করে লিমপেট মাইন, একটি ছুরি, একজোড়া সাঁতারের ফিন আর কিছু শুকনো খাবার নিজেদের সঙ্গে রাখতে হবে। প্রতি তিনজন সদস্যদের মধ্যে একটি স্টোন গান দেওয়া হয়েছিল। 

রেডিওতে প্রথম গানটি বাজানো হয়েছিল ১৪ ই আগস্ট এর পরবর্তী গানটি বাজানো হয়েছিল ১৫ই আগস্ট। এছাড়াও বন্দরে আরও অসংখ্য গোলাবারুদ ও নানা ধরনের অস্ত্রশস্ত্র স্টক করে রাখা হয়েছে। ৩১ জন কমান্ডো সরাসরি অপারেশন অংশগ্রহণ করেছিল।

মূলত ১৬ ই আগস্ট প্রথম প্রহরে রাত ১ টায় নৌ কমান্ডোরা  যাত্রা শুরু করে জাহাজের উদ্দেশ্যে। সাঁতরানোর মাধ্যমে তারা দ্রুততর ভাবে তাদের টার্গেট করা জাহাজে মাইন লাগিয়ে কেটে সরে আসে। 

রাত ১ টা ৪০ মিনিটে পর থেকে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটে, যার ফলে শত্রুবাহিনীর তিনটি বড় অস্ত্রবাহী জাহাজ পানিতে তলিয়ে যায়। 

মোংলা বন্দরে অপারেশন 

মংলা বন্দরের অপারেশন ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন। ১৩ই আগস্ট ৬০ সদস্যের একটি কমান্ডো দল ভারতীয় অংশ পার করে সুন্দরবন  দিয়ে বাংলাদেশ অংশে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে ১৫ ই আগস্ট রাত ১২ টার দিকে ৪৮ জন সদস্য  মংলা বন্দরে উদ্দেশ্যে রওনা হয়। 

এ ৪৮ জন সদস্যদের মধ্যে ৬ জন করে ভাগ করে একেকটি দল বানানো হয়েছিল, যাদের টার্গেট ছিল একটি দল একটি জাহাজ ধ্বংস করবে।

দলের সদস্যদেরকে  বলে দেয়া হয়েছিল যে যত দ্রুত সম্ভব সাঁতরিয়ে লিমপেট মাইন জাহাজের তলদেশের লাগিয়ে সরে পড়তে হবে। মংলা বন্দরে সকাল ৬ টা নাগাদ বিস্ফোরণ গুলি ঘটে। 

এই অপারেশনের মাধ্যমে একটি সোমালীয় জাহাজ, একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় জাহাজ, একটি চীনা জাহাজ, একটি জাপানি এবং একটি পাকিস্তানি জাহাজ সহ মোট ৬ টি অস্ত্রশস্ত্র ভোরা তেলবাহী বিদেশি জাহাজ ধ্বংস করা হয়েছিল। 

চাঁদপুর বন্দর অভিযান 

১৯৭১ সালের ১৬ ই আগস্ট মধ্যরাতে চাঁদপুর নদী বন্দরে অপারেশনটি  পরিচালনা করা হয়। 

মূলত ১৮ জন নৌ কমান্ডোকে নিয়ে চাঁদপুর অপারেশন পরিচালনা করা হয়েছিল।

এখানে ৩ জন করে দল ভাগ করে মোট ৬টি দল করা হয়েছিল। বন্দরে থাকার নোঙ্গর করা জাহাজগুলোতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দুটি স্টিমার, গমবাহী একটি জাহাজ ও অনেকগুলো নৌযান ধ্বংস করা হয়েছিল। 

নারায়ণগঞ্জে অভিযান 

নারায়ণগঞ্জে অভিযান পরিচালনা করেন ২০ জন কমান্ডো সদস্য। আগস্ট মাসের ১৬ তারিখে পরিচালিত নারায়ণগঞ্জের অপারেশনে মোট চারটি জাহাজ ও অনেকগুলি নৌযান বিস্ফোরণের মাধ্যমে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছিলো। 

ঠিক সেই সময়ই দাউদকান্দি নদী বন্দেরেও  হামলা চালানো হয়েছিল। এই অপারেশনে নৌ কমান্ডোরা নিজেদের  সাহসিকতার পরিচয় দেন।

অপারেশন জ্যাকপটের প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল? 

অপারেশন জ্যাকপট এর আওতায় নৌকমান্ডোরা একসাথে চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, মংলা, ও চট্টগ্রাম বন্দরে আক্রমণ পরিচালিত করার মাধ্যমে পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর মোট ২৬ টি পণ্য ও সমরাস্ত্র বাহী জাহাজ ও গণবোট ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে একযোগে চালানো এসব হামলার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল খুবই মারাত্মক। এতে করে পাকিস্তানি বাহিনী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে। 

খুব দ্রুত চাঁদপুর, মংলা এবং চট্টগ্রামে হেলিকপ্টারে করে টহল শুরু করে পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীর সদস্যরা । যেখানে যেখানে অপারেশন পরিচালনা করা হয়েছিল তার আশেপাশের গ্রামগুলো আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতে শুরু করে। 

পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী যতই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করুক না কেন অপারেশনটি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় অপারেশন জ্যাকপট পরিচালিত হওয়ার খবর বিশ্বের বড়-বড় নিউজ পত্রিকায় বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল। যেহেতু সেখানে বিশ্বের অন্যান্য দেশের জাহাজও ধ্বংস হয়েছিল। 

এই অপারেশনটি পরিচালনা করার ফলে বিদেশী জাহাজগুলো নিরাপত্তার কারণে চট্টগ্রাম বা  মংলা বন্দরে আসতে রাজি হচ্ছিল না । যেহেতু এই অপারেশনের ফলে বিদেশি জাহাজ গুলোও ধ্বংস হয়েছিল সেহেতু এই খবরটি সারাবিশ্ব অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে নৌ অভিযানের সূত্রপাত হয়েছিল 

অপারেশন জ্যাকপটের ফলাফল 

অপারেশন জ্যাকপটের এই অপারেশন গুলোতেই প্রায় ৫০৮০০ টনের মোট ২৬ টি জাহাজ পুরোপুরিভাবে ধ্বংস হয়েছিল। আর নৌযানের সংখ্যা ছিল অসংখ্য । ১৬ ই আগস্ট এ পরিচালিত অপারেশনের পর এসব কমান্ডো পরবর্তীতে ভারতে ফেরত চলে যায়। সুতরাং আমরা এই আটিকেল থেকে জানতে পারলাম অপারেশন জ্যাকপট কি এবং কেন হয়েছিল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top