গরু আমাদের দেশে খুবই পরিচিত গৃহপালিত একটি পশু। গরু পালন একটি লাভজনক পেশা। গরু লালন পালন করা হয় মূলত দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার মাংস এবং চামড়ার জন্য। গরুর মাংস খুবই সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। যা খেতে ছোট থেকে বড় সবাই অনেক পচন্দ করে।
সঠিকভাবে গরু লালন পালন করে অধিক লাভবান হওয়া যায় আবার সঠিক নিয়মে লালন-পালন করতে না পারলে লোকসানও গুনতে হয়। বর্তমানে এখন গরু মোটাতাকরণ খামার করে অনেকেই নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে।
গরু মোটাতাজাকরণ
দেখা যায় গরু মোটাতাজাকরণ দানাদার খাদ্য তালিকা অনুসরণ করে গরু লালন পালন করা গেলে অধিক পরিমাণে লাভবান হওয়া যায়। তাই আজকের এই আর্টিকেলটি গরু মোটাতাজাকরণের সকল বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
পরিকল্পিতভাবে গরুর খামার করলে অধিক পরিমাণে লাভবান হওয়া সম্ভব। গবেষণায় দেখা গেছে সারাবিশ্বে প্রায় ১৩৫ কোটিও অধিক গরু রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় ২ কোটির অধিক গরু।
গরু নির্বাচন করা
গরু মোটাতাজাকরণ পদ্ধতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে গরু নির্বাচন করা। মূলত উন্নত জাতের গরু গুলোই খামারে মোটাতাজাকরণ করা হয়। গরু নির্বাচন করার সময় খেয়াল করে দেড় থেকে দুই বছর বয়সের সংকর জাতের ষাড় বাছুর নেওয়া উচিত। গরুটি যাতে রোগ মুক্ত হয় এবং সম্পূর্ণরূপে সুস্থ থাকে সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।
গরুর জন্য বাসস্থান নির্মাণ
গরুর ঘরটি এমন জায়গায় তৈরি করতে হবে যেখানে পর্যাপ্ত পরিমান আলো বাতাস ঢুকতে পারে, সে বিষয়টি খুব খেয়ালের সহিত মাথায় রাখতে হবে। গরুর মলমূত্র যাতে খুব সহজেই অপসারণ করা যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। গরু ঘরের মেঝে যাতে সেতসেতে না থাকে সে বিষয় খেয়াল রাখতে হবে।
গরু মোটাতাজাকরণ দানাদার খাদ্য তালিকাঃ
যদিও গরু মোটাতাজাকরণ দানাদার খাদ্য তালিকার সঠিক নিয়ম মেনে গরু লালন পালন করা খুবই চ্যালেঞ্জিং বিষয। গরু মোটাতাজাকরণ এটা দীর্ঘসময়ের কাজ নয়। মূলত ঈদুল আযাহার ঈদের তিন চার মাস আগে থেকে গরুকে যত্ন করলে অধিক লাভবান হওয়া যায়।
গরু মোটাতাজাকরণের ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে ভাল জাতের গরু নির্বাচন করা। গরুকে কৃমি মুক্ত করতে হবে, বাসস্থান তৈরি করতে হবে, নিয়মিত গরুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা, গরুকে সুষম খাদ্য প্রদান ইত্যাদি।
গরুর দানাদার খাদ্য
যে সকল খাদ্য সমূহ আয়তনের তুলনায় গুণগতমান অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি হয় তাদেরকে দানাদার খাদ্য বলে। দানাদার খাদ্য সমূহ হলো ছোলা, খেসারি ভুট্টা, গমের ভুসি, শুকনা মাছের গুড়া, সয়াবিন, বিভিন্ন প্রকার কলাই ইত্যাদি। আমিষের পরিমাণ এর ভিত্তিতে দানাদার খাদ্য সমূহকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
- কম আমিষ সমৃদ্ধ খাদ্য হলো ভুস, কুড়া (৫ – ১৫%) আমিষ থাকে।
- মধ্যম মান সমৃদ্ধ খাদ্য হলো কলা, খৈল, ছোলা (২০ – ২৫%) আমিষ থাকে।
- উচ্চ আমি সমৃদ্ধ খাদ্য হলো শুকনো মাছের গুড়, রক্তের গুড়া, কসাই খানার মাংসের কণা (৩৫ – ৪৫%) আমিষ থাকে।
আমাদের দেশে ব্যবহৃত প্রধান দানাদার খাদ্য গুলি হলো গমের ভুসি, চাউলের কুঁড়া, ভুট্টা, সয়াবিন মিল, চাউলের খৈল, কলাই মটর, খেশারী ইত্যাদি।
এগুলোর সাথে পরিমাণমতো বিভিন্ন সাপ্লিমেন্ট, ভিটামিন ও মিনারেল মিশিয়ে সুষম দানাদার খাদ্য তৈরি করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে গরু মোটাতাজাকরণ খাদ্য তৈরিতে গুণগত মানের দিকে বেশি নজর রাখতে হয়।
গরু মোটাতাজাকরণ খাদ্য তালিকা
আমাদেরকে প্রথমেই মনে রাখতে হবে দানাদার গরুর প্রধান খাদ্য নয় গরুর প্রধান খাদ্য হচ্ছে ঘাস। দানাদার খাদ্য গরু সহায়ক হিসেবে কাজ করে থাকে। ঘাস গবাদিপশুর পুষ্টির উৎস। সাধারণত একটি গবাদিপশুর ওয়েট এর ৪% ঘাস দৈনিক তাকে বাধ্যতামূলক দিতেই হয়।
ফিড ফরমুলেশন বা গরু মোটাতাজাকরণ দানাদার খাদ্য তালিকা প্রস্তুত করা একটি চ্যালেঞ্জ এর বিষয়। গরু মোটাতাজাকরণ খামারে লাভ নির্ভর করে সঠিক খাদ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। গরু মোটাতাজাকরণ খামার গবাদিপশুকে সঠিকভাবে সুষম খাদ্য সরবরাহ করা সবচেয়ে জরুরি।
খাবারের তালিকায় ভিটামিন, আমিষ,শর্করা ও চর্বির পরিমাণ অনেক বেশি রাখতে হবে। গরুকে প্রচুর পরিমাণে টিউবওয়েলের টাটকা পানি খাওয়াতে হবে। গরুকে খড় খাওয়ানোর সময় সুনির্দিষ্ট নিয়মে ইউরিয়া ও চিটাগুড় মিশ্রিত করে খাওয়াতে হবে।
১৫০ – ২০০ কেজি ওজনের একটি গরুকে দিনে ৩ – ৪ কেজি দানাদার খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। দানাদার খাদ্যের স্বাদ লবণ, মিনারেল প্রিম্কিস ভিটামিন, ক্যালসিয়াম অবশ্যই মিশিয়ে খাওয়াতে হবে। অন্যদিকে দুপুরে গরুকে চাহিদার পরিমাণ অনুযায়ী খুদের জাও খাওয়ানো যেতে পারে।
গরু মোটাতাজাকরণ দানাদার খাদ্য তালিকার পরিমাণ
মোটাতাজা গরুর ১০০ কেজি রেশন তৈরীর ফর্মুলাঃ
গমের ভূষি = ৩০ কেজি
ভুট্রা ভাঙ্গা = ২০ কেজি
রাইচ পালিশ = ১৫ কেজি
ডাউলের ভূষি = ৭ কেজি
সরিষার খৈল = ১০ কেজি
সয়াবিন খৈল = ১০ কেজি
চিতাগুড় = ৩ কেজি
ডিসিপি পাউডার = ৩ কেজি
আয়োডিন লবন = ২ কেজি
মোট = ১০০ কেজি
দানাদার খাদ্যে সরাসরি ইউরিয়া ব্যবহার
খাদ্যে প্রোটিন, চর্বি,কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ চাহিদা মতাবেক খাবারের মাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে কিনা সেটাও বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।আধুনিক যুগে গরু মোটাতাজাকরণের জন্য খাদ্যের সাথে ইউরিয়ার ব্যবহার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে।
এক ধরনের রাসায়নিক সার হচ্ছে ইউরিয়া। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে প্রাণী খাদ্যে আমিষের পরিমাণ খুব কম থাকে, এই আমিষের অভাব পূরণের জন্যই ইউরিয়া অনেক কার্যকর ভূমিকা পালন করে। ইউরিয়া যুক্ত খড় প্রাণীকে খাওয়ালে প্রাণী দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এজন্য প্রাণীর স্বাস্থ্য ও গরু মোটাতাজাকরণের জন্য অত্যাবশ্যক হিসেবে কাজ করে ইউরিয়া সার।
গরুকে মূলত তিনটি পদ্ধতিতে মিশ্রিত করে উন্নতমানের খাবার দিতে হবে।
১। আঁশ জাতীয় খড় গবাদি পশুকে খাদ্যের সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে দিতে হবে।
২। দানাদার খাদ্যের সাথে সরাসরিভাবে এবং
৩। ইউরিয়া মোলাসেস বুকের মাধ্যমে খাওয়াতে হবে
খড়ের সাথে মিশানোর মাধ্যমে ইউরিয়া সার খাওয়ানোর নিয়ম হলঃ
খড় প্রক্রিয়াজাতকরণ ১০ কেজি খড় ১০ কেজি পানি এবং ৫০০ গ্রাম সার একসাথে মিশিয়ে ইটের তৈরি হাউজে ৭-১০ দিন আবদ্ধবায়ুরোধী অবস্থায় রেখে দিতে হবে।
তারপর ঐ খড়গুলো বের করে রৌদ্রে শুকিয়ে ইউরিয়া তীব্র গন্ধ কিছুটা কমাতে হবে।খড়গুলো গরু না খেলে কিছু পরিমান চিড়াগুড় মিশিয়ে দিতে হবে।
ইউরিয়া মিশ্রিত খাদ্য তালিকা, উপকরণ ও পরিমাণঃ
ধানের খড় = ২ কেজি
সবুজ ঘাস = ২ কেজি (ঘাস না থাকলে খড় ব্যবহার করা যেতে পারে)
দানদার খাদ্যে মিশ্রন = ১.২-২.৫ কেজি
ইউরিয়া = ৩৫ গ্রাম (নিয়মানুযায়ী)
চিটাগুড়া = ২০০-৪০০ গ্রাম
লবণ = ২৫ গ্রাম
গাঁজানো ভুট্টা
শুরুতে ভুট্টার গুড়া নিতে হবে। ভুট্টার গুড়া গুলো যাতে সুজির দানার মত হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তারপর ভুট্টার গুড়া পর্যাপ্ত পানিতে মিশিয়ে নিতে হবে। মেশানোর পর ১৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।
পরবর্তীতে মিশ্রিত খামির টি বালতি বা পাত্রে রেখে সাত-আট ঘণ্টা বায়ুরোধী করতে হবে। বায়ুরোধী দ হয়ে গেলে ভুট্টা কে খড় বা ঘাসের সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে।
ফার্মেন্টেটেড কর্ন
শুরুতেই ভালোভাবে ভুট্টা গুড়া করে নিতে হবে। এরপর ভুট্টা গুড়াগুলো পানির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। তারপর সামান্য কুসুম গরম পানিতে এক চা চামচ চিটাগুড় ও এক চা চামচ বেকারি ইস্ট ভালোভাবে মিশাতে হবে।
এগুলো মেশানোর পর ১০-১৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। অতঃপর চিটাগুড় মেশানো ইস্ট ও ভুট্টা গুড়া একসাথে মিশিয়ে রাখতে হবে ৮ – ১০ ঘন্টা। ব্যাচ তৈরি হয়ে গেল ফার্মেন্টেটেড কর্ন। এখন এগুলো দানাদার খাদ্যের সাথে বা খড়ের সাথে মিশিয়ে গরুকে খাওয়াতে হবে।
পরিসমাপ্তি
উপযুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কিছু সঠিক কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে গরু মোটাতাজাকরণ খামারে কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়া সম্ভব। এতে করে খামারিদের লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা থাকেই না। বরঞ্চ প্রত্যাশার চাইতেও অধিক পরিমাণে লাভবান হওয়া যায়। পরিশেষে বলতে পারি যে গরু মোটাতাজাকরণ দানাদার খাদ্য তালিকা সম্পর্কে আমরা একটি উপযুক্ত ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয়েছি।