মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা একটি অধিদপ্তর। যা বাংলাদেশের সকল ধরণের মাদরাসাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। দেশের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সমস্ত মাদরাসাগুলোকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে এসে এখানকার ছাত্র-শিক্ষক এবং সার্বিক শিক্ষার মান উন্নয়নে এই প্রতিষ্ঠানটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর
ইসলামিক শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক ও যুগোপযোগী সাধারণ শিক্ষা দক্ষ মানব সম্পদ তৈরিতে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এই বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিক করার প্রয়োজনীতা দেখা দেয়। কারণ এই শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলামিক শিক্ষা ছাড়া সাধারণ শিক্ষার মান নিয়ে অনেক অভিযোগ ছিল আগে থেকেই। মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা এই শিক্ষা কার্যক্রমকে সম্পূর্ণ নতূন আঙ্গিকে প্রণয়ণের মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিক করার সকল ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
প্রতিষ্ঠা
আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় যে ধারাগুলো রয়েছে তার মধ্যে মাদরাসা শিক্ষা এর গুরুত্ব কোনভাবেই অবহেলা করার মতো নয়। এই ধারায় দেশে প্রায় ১৫ হাজার স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেখানে প্রায় দেড় লক্ষাধিক শিক্ষক শিক্ষাদান করে চলেছে। পরিবর্তনশীল সমাজের জাহিদা পূরণ করার জন্য মাদরাসা শিক্ষা আধুনিক ও যুগোপযোগী হওয়া একান্ত প্রয়োজন। এর মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার সাথে মাদরাসা শিক্ষার যে ব্যবধান রয়েছে তাও কমে যাবে।
তাই গুনগত মান উন্নয়ন, সুষ্ঠরূপে পরিচালনা, যথাযত তদারকী, পরিবীক্ষণ ও একাডেমিক পরিদর্শন এর মতো কার্যক্রমকে জোরদার করার জন্য মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাছাড়া ২০১০ এর শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করার জন্য কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী এই প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি বর্তমানে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে বিশেষ শাখার পরিবর্তে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করছে।
ইতিহাস
ভারতীয় উপমহাদেশে আলাদাভাবে ইসলামিক শিক্ষা ব্যবস্থার সূচনা হয় ১৭৮০ সালে। এই সময় কলকাতা আলিয়া মাদরাসা নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামিক ধারার শিক্ষা কার্যক্রমের শুরু। পরবর্তীতে এই শিক্ষা ব্যবস্থা মুসলিম সমাজে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে অবিভক্ত বাংলা, বিহার, আসাম ও ত্রিপুরা সহ আরো অনেক অঞ্চলে সম্প্রসারিত হতে থাকে। অ্যাসাইনমেন্ট লেখার সঠিক নিয়মাবলী জেনে নিন!
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমাদের দেশে মাদরাসা শিক্ষা খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করে। জতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর প্রত্যক্ষ্য নির্দেশনায় এই সময় মাদরাসা শিক্ষাকে সময় উপযোগী এবং কর্মমূখী করার সব রকম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এর ধারবাহিকতা হিসাবে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড গঠন করা হয়। তখন ঢাকার সরকারি মাদরাসা-ই-আলিয়া ক্যাম্পাসে এর কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল।
পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে মাদরাসা শিক্ষা অর্ডিনেন্স জারি করা হয় এবং বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়। পর্যায়ক্রমে ১৯৭৯ সালের জুন মাসে মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করছে। কিন্তু সমস্যা হয় দেশে বিদ্যমান সব ধরণের মাদরাসাকে শিক্ষা বোর্ডের অধীনে আনা সম্ভব হয় না।
যে কারণে ২০১৫ সালে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের অধীনে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি তুলনামূলকভাবে নবসৃষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান। উক্ত সালের আগস্ট মাস থেকে কাকরাইলস্থ জাতীয় স্কাউট ভবনে ভাড়া অফিসে এই অধিদপ্তরের কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু অফিসের পরিসর স্বল্প হওয়ার কারণে ঠিকমত কার্যক্রম পরিচালনা করা যাচ্ছিল না। পাশাপাশি কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও ছিল না। তাই পরবর্তীতে নিউ বেইলি রোডের গাইড হাউসে ভাড়ার ভিত্তিতে এই অধিদপ্তরটিকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য – মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর
মাদরাসা শিক্ষা দীর্ঘদিন ধরে পুরাতন ধারায় চলমান ছিল। বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালে নতুন জাতীয় শিক্ষাণীতি প্রণয়ন করে। এই শিক্ষানীতিতে মাদরাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার জন্য অধিক পরিমাণ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিক ও সময় উপযোগী করে গড়ে তোলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহীতা নিশ্চিত করা এবং সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা বি-কেন্দ্রীকরণের অংশ হিসাবে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়।
মাদরাসা শিক্ষার বিভিন্ন স্তর রয়েছে যেমন স্বতন্ত্র এবতেদায়ী, সংযুক্ত এবতেদায়ী, দাখিল, আলিম, ফাযিল ও কামিল মাদরাসা। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা ব্যবস্থা সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করে একে বাস্তবমুখী, সময় উপযোগী এবং আধুনিক করার লক্ষ্যে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে। সেই সাথে জীবনদক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষার প্রসার এবং গুনগত মানের উন্নয়ন এই অধিদপ্তরের অন্যতম প্রচেষ্টা। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এর সকল তথ্য জানুন!
কার্যক্রম
জাতিকে বিশ্বের দরবারে সম্মানজনক পর্যায়ে পৌছানোর জন্য শিক্ষার উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। তাই মাদরাসা শিক্ষাতেও একটি টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে এই অধিদপ্তর বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। এই অধিদপ্তরের মাধ্যমে দেশের ৭৯৫৪ টি এমপিও ভুক্ত মাদরাসায় ১,৫০,৮০০ জন শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ১৫১৯ টি এবতেদায়ী মাদরাসায় প্রায় ৪৫২৯ জন শিক্ষকদের নিয়মিত অনুদান দেওয়া হয়।
মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর এই বিপুল পরিমান শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রশাসনিক এবং একাডেমিক বিষয়ে সার্বিক মনিটরিং করে। সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠিকে বেশি মাত্রায় সেবা দেওয়ার জন্য আলাদা একটি অধিদপ্তর হিসাবে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশের প্রতিটি নাগরিককে দক্ষ ও কর্মক্ষম হিসাবে গড়ে তুলতে পারলেই কেবল দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব। যা এই অধিদপ্তরের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
সরকার কর্তৃক মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর এর জন্য কর্মপরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে যা নিম্নরূপ:
- মাদরাসা শিক্ষা সংক্রান্ত সরকারি নীতি বাস্তবায়ন করা।
- কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ প্রদত্ত্ব মাদরাসা শিক্ষা সংক্রান্ত সকল উপদেশ ও পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া।
- সরকারি/বেসরকারি মাদরাসাগুলোর আদর্শ মান সুনিশ্চিত করার জন্য কৌশল নির্ধারণ ও তা প্রয়োগ করা।
- মাদরাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের একাডেমিক, প্রশাসনিক এবং আর্থিক কর্মকাণ্ড তত্ত্বাবধান করা।
- অর্গানোগ্রাম মোতাবেক মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর ও এর অধীন প্রতিষ্ঠান/শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ/বদলি/পদোন্নতি ও চাকুরী সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা।
- মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের ও অধিনস্ত মাদরাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাজেট প্রণয়ন করা ও আয়ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ।
- বেসরকারি মাদরাসা এবং শিক্ষক কর্মচারী এমপিও ভুক্তকরণ।
- বেসরকারি মাদরাসার গভর্নিংবডিতে সদস্য মনোনয়ন সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা।
- মাদরাসা সংক্রান্ত উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন অগ্রগতি তত্ত্বাবধান।
- সকল প্রকার মাদরাসার প্রশাসনিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান।
- সকল প্রকার পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব পালন।
- গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন গ্রহণ করা।
- সকল গুরুত্বপূর্ণ কাজের রিপোর্ট সমূহ নিয়মিত মন্ত্রণালয় পাঠানো।
অধীনস্ত অফিস সমূহ – মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর
মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর এর অধীনে যে অফিসগুলো রয়েছে তা নিম্নরূপ:
- সরকারি মাদরাসা: এই অধিপ্তরের অধিনে মোট তিনটি সরকারি মাদরাসা আছে। এগুলো হলো ঢাকার লালবাগে অবস্থিত মাদরাসা -ই-আলিয়া, সিলেট সদরে অবস্থিত সিলেট সরকারি কামিল মাদরাসা এবং বগুড়া সদরে অবস্থিত সরকারি মুস্তাফাবিয়া কামিল মাদরাসা।
- বেসরকারি মাদরাসা: বিভিন্ন স্তরের ৫২১০ টি মাদরাসা কে শিক্ষা অধিদফতরের অধীনে আধিভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদরাসার সংখ্যা ৩৪৩৩টি, দাখিল মাদরাসার ৬৫৯৩ টি, আলিম মাদরাসার সংখ্যা ১৫৫৮টি এবং কামিল মাদরাসার সংখ্যা ২১৯টি।
- বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট: মাদরাসা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট বা বিএমটিটিআই হলো দেশের একমাত্র সরকারি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট। ১৯৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসম্পদ তৈরিই এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য। এই ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে বিশেষভাবে মাদরাসার শিক্ষক এবং সাধারণভাবে দেশের অন্যান্য স্কুল কলেজ শিক্ষকদের চাকুরীপূর্ব ও চাকুরীকালীন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
উপসংহার
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩০ ভাগ মাদরাসা শিক্ষার সাথে জড়িত। তাই সামগ্রিকভাবে দেশের জনগনকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে হলে মাদরাসা শিক্ষাকে অবশ্যই মূলধারার শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা প্রয়োজন।
মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর এই লক্ষ্য নিয়ে এখন পর্যন্ত সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের একান্ত প্রচেষ্টার কারণে হয়ত আমরা খুব শিঘ্রই পিছিয়ে থাকা মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকেও আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা হিসাবে দেখতে পাবো। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এর সকল তথ্য জানুন!